বাক্‌ ১৫২ ।। সম্পাদকীয়

 


এই মুহূর্তে যতদূর মনে হচ্ছে, আগামী দিনের কবিতাচর্চা ক্রমশই ব্যক্তিগত পরিসরের দিকে সরে আসবে কবিরা গোষ্ঠীবদ্ধতার দিকে যাবেন না এটা ঘটবেই, কারণ এই ২০২৩-এর মাঝামাঝি এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাঙালি ক্রমেই একাকিত্বের দিকে ঝুঁকছে কবিরা যে জোট বাঁধতেন, দল গড়তেন, একসঙ্গে মিলে পত্রিকা চালাতেন, যূথবদ্ধতার মধ্যেই নিজেদের আইডেন্টিটি খুঁজতেন, সেটা মূলত বিংশ শতাব্দির দৃশ্য আগামী দশ বছরে যাঁরা কবিতা লিখতে আসবেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বাংলা কবিতার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে কোনো ধারণা থাকবে না এটাই হয় এঁরা কিছুদিন লেখার চেষ্টা করবেন, মূলত অপ্রাসঙ্গিক ও এলোমেলো লেখাই লিখবেন, তারপর ছেড়ে দিয়ে বিবাহ চাকরি বা অন্য কোনো কোনো দিকে চলে যাবেন যাঁরা সচেতন হয়ে কবিতা লিখতে আসবেন, যাঁরা স্থায়ী হবেন, তাঁরা হতাশ হয়ে দেখবেন বাঙালির কবিতার কোনো প্রয়োজন নেই তাঁরা তাঁদের হতাশাকে অতিক্রমও করবেন ফলে তাঁরা সেই কবিতাই লিখবেন যে কবিতা বাংলা কবিতার কোনো না কোনো শূন্যস্থান পূর্ণ করতে পারবে অর্থাৎ তাঁরা সাধনার দিকে যাবেন, তাঁদের কবিতার পিছনে দীর্ঘ প্রস্তুতির চিহ্ন থাকবে যে কারণে কবিদের জোট বাঁধতে হয়, অর্থাৎ সমবেত চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া, সেটার জন্য এঁরা নিজেদের লেখার উপরেই নির্ভর করবেন এঁদের সংখ্যা খুবই কম হবে কিন্তু যে কোনো সময়েই বাংলা কবিতায় সিরিয়াস কবিদের সংখ্যা কমই হয়েছে

আর পাঠক? কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা পড়া অনেক কঠিন কবিতা অনেক সময় নিজেই লিখিত হয় কবি মাধ্যম হয়ে থাকেন মাত্র কবিতা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় নিজেকে কবির দায় থাকে না তিনি কী লিখেছেন কেন লিখেছেন তার কৈফিয়ত দেওয়ার কিন্তু পাঠক? কবিতা পড়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয় তাঁকে দীর্ঘ অনুশীলন লাগে কবিতা পড়ার জন্য কারণ প্রত্যেকটা পাঠে সেই কবিতা নতুন করে নির্মিত হয় কবির ভিতরকার যাবতীয় গরল যাবতীয় বিষ পাঠককেই গলায় ঢেলে নিতে হয় অমৃতও তিনি পান, কিন্তু সাধনার বিনিময়ে আমার কাছে কবি একজন গবেষক, প্রায়ই দিব্যতা তাঁর সহায় হয় কিন্তু পাঠক একজন অভিযাত্রী, একজন এক্সপ্লোরার, আদিগন্ত মরুভূমি বা অনন্ত তুষারপ্রান্তর ঠেলে তিনি একটা কবিতার মর্মকেন্দ্রে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন পথের ধারে পড়ে থাকা সোনার টুকরো চিনে নিতে পারেন সেই প্রস্তুতি তাঁর আছে অন্যথায় তিনি সোনার বদলে রাংতার টুকরোই তুলে নেবেন, আর নাচবেন যদি তাঁর প্রস্তুতি না থাকে কিন্তু কবিতার পাঠক আমার কাছে দেবতা

          আমাদের বাঙালি জাতটার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ইতিহাসবোধের অভাব আর সৌন্দর্যবোধ না থাকা সুদূর তো ছেড়ে দিন, অদূর অতীতেই কী ঘটে গেছে, আমরা মনে রাখি না আমাদের চোখের সামনে যদি ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়, আমরা ধরতেই পারবো না, কারণ আমরা ইতিহাস কাকে বলে জানি না সুন্দর কাকে বলে আমরা জানি না প্রায়ই লাবণ্যকে সৌন্দর্য বলে ভুল করি ফলে কবিতা যখন পড়তে বসি, সেই কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে কোথায় আছে, সেসব বিচার করতে পারি না ভাবি সেসব পণ্ডিতরা করবে ওটা কিন্তু পণ্ডিতদের কাজ নয় ওটা পাঠকেরই দায়, কারণ সেটা নাহলে তাঁর রসবোধ পূর্ণতা পাবে না কোন কবিতায় সুররিয়াল আছে, আর কোন কবিতায় জাদুবাস্তব, কোনটা উপমা আর কোনটা রূপক, কোনটা শ্লেষ আর কোনটা যমক, সেসব নির্ধারণ কি পণ্ডিত করবে নাকি? আপনি তাহলে কী কারণে 'বাহ্‌' বলবেন বা 'কিস্যু হয়নি' বলবেন? কবির ওস্তাদি আপনি যদি বুঝতেই পারলেন না, আপনি কিসের সমঝদার? আপনি হয়ত বলবেন ভাল লাগা আর খারাপ লাগাই কবিতার সার্থকতার পরম ব্যাপার কিন্তু বন্ধু নিজের ভাল লাগা আর খারাপ লাগাকেও প্রশ্ন করতে হয়, নাহলে নিজের চেতনাকে বুঝবেন কী করে? আরেকটা সমস্যা হল- সুন্দর ফর্সা আর সপ্রতিভ উচ্চারণকে আমরা প্রায়ই সুন্দর কবিতা বলি অথচ, হয়ত তারই আড়ালে লুকিয়ে আছে কবির হতাশা বা মৃত্যুবোধের গূঢ় ইশারা আপনি লাবণ্যে আটকে গেলেন, সুন্দর ভাবলেন অথচ কবিতাটা হয়ত খুবই কুটিল বীভৎস

          বাক্১৫২প্রকাশিত হতে অনেক সময় নিল তার কারণ আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততা একটা বড় লেখার কাজ চলছিল দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদক হওয়ার জন্য যে নিবেদিত প্রাণ দরকার, আমার তা নেই আমি আগে লেখক, আগে নিজের লেখার কথা ভাবি, তারপর পত্রিকার জন্য চিন্তা করিবাক্‌’-কে তাই আজকাল দেরিতে আসতে হচ্ছে এই সংখ্যার জন্য একশ জনের উপর কবিতা পাঠিয়েছিলেন বেশ কিছু আমন্ত্রিত কবিও ছিলেন প্রচুর কবিতা এই সংখ্যায় ছাপা হল কিছু কবিতা আগামী সংখ্যার জন্য তুলে রাখা হলবাক্‌’-এর একটা নির্বাচিত সংকলনের কাজ চলছে সেটা কাগজের বই হবে অনলাইন নয় বছরের মধ্যেই তার এসে পড়ার কথা

বাক্‌’ অবিশ্যি প্রায়ই তার নিজের ইন্ধন নিজেই খুঁজে নেয় আমি কখন ডিজেল ঢালব, খুব একটা অপেক্ষা করে না আমি স্টিয়ারিং-টা ধরে রাখলেই চলে তাই আমি নিজেকে সম্পাদক বলি না পরিচালক বলি 

 

                                        অনুপম মুখোপাধ্যায়

                                        পরিচালক : বাক্অনলাইন