বাক্-স্বাধীনতা : ব্যক্তিগত দর্শন -- দ্বাদশ পর্ব
দর্শনের যেকোনো আলোচ্য বিষয়ে আলোকপাত
করতে হলে শুরুটা অবশ্যই প্রাকৃতিক ন্যায়-নীতির প্রসঙ্গ ধরেই
করতে হতে পারে। বিষয়টি যত দ্বন্দ্বময় হবে, তত সেখানে থাকবে
মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যত বেশি থাকবে, বিষয়টির মধ্যে খুলে যাবে দিগন্ত, আসবে জ্ঞানের
বিচ্ছুরণ। প্রাচীন গ্রিসে জীবন সম্পর্কে আলোচনাই ছিল জীবনকে জানার ও চেনার শিক্ষা। বোধ ও বিজ্ঞান । ছিল ধর্ম, তত্ত্ব, এবং যুক্তির পরীক্ষা। রুশো তাঁর 'সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট'
বইয়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
'প্রাকৃতিক ন্যায় ও নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত ব্যবস্থাই হল সামন্ততান্ত্রিক
ব্যবস্থা।' অর্থাৎ, এটি প্রকৃত অর্থে
কোনো বৈষম্যমূলক বিধান নয়, তবু ধীরে ধীরে একটি জাতির বেঁচে
থাকার মধ্যে এই ব্যবস্থা অংসখ্য প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়। ফলে একটি নির্দিষ্ট জাতি
স্রেফ বৈষম্যের ভিত্তিতে পরিণত হয় শ্রেণিতে, পরবর্তীতে আরও
ভালো করে বললে বলা হবে দাসে। অর্থাৎ, সার্বভৌম এবং শাসিত
সমাজে একটি জাতির চরিত্র তুলে ধরে সেই জাতির বঞ্চনাগ্রস্ত নির্বিকার উদাসীন স্বার্থপর
লোকেরা। চিরদিন ও চিরকাল তাই হয়ে চলবে। কেননা জাতির মধ্যেকার শক্তি সর্বদা নিহিত
থাকে সামান্য কিছু মানুষের ভিতর। সেই মানুষকে প্রথমে লড়াই করতে হয় ঐ স্বার্থান্বেষী
লোকসমষ্টির সঙ্গে, কেননা প্রয়োজনীয় উপায় ব্যতীত শাসিত জাতিকে
শাসক সর্বদা গুরুত্ব দেবে এমন নয়। শাসিত জাতিমাত্রই শোষণকে চিরকাল নিরাপত্তার মূল্য
হিসাবে আনুগত্য জুগিয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র যখন একটি শোষিত
জাতিকে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে, তখন সেই জাতি
নিজস্ব জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে কিংবা রাষ্ট্রে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে
প্রশ্নহীন থাকবে, এটাই তারা মনে করে। কিন্তু এই পরাধীনতার
শৃঙ্খল ভাঙা শুরু হয় তখনই, যখন কোনো ব্যক্তি-নাগরিক নিজস্ব জাতির ত্রুটিগুলি নিয়ে জাতিরই মধ্যে সরব হয়। তার দাবি ন্যায়
ও স্বচ্ছ থাকলে প্রথমেই তা দীর্ঘকালীন প্রথাকে আঘাত করে বসে। তখন বেশিরভাগ মানুষ তার
বিরোধিতা করে। কেননা মানুষমাত্রই সমাজব্যবস্থার দাস। অর্থ নির্ভর সমাজের মানুষ অর্থলোভী,
যৌনতা নির্ভর সমাজের মানুষ কামুক। পরবর্তীতে দেখা যায় ন্যায় যখন
মানুষকে জীবনের চাপে ফেলে শিখতে এবং শেখাতে বাধ্য করে, তখন
ধীরে ধীরে জাতির সকলে সেই ব্যক্তির সমর্থনে ও নেতৃত্বে নিজেদের রাষ্ট্রবিদ্রোহী হিসাবে
গড়ে তোলে।
রাষ্ট্র নিজে মানুষ নয়, তথাপি রাষ্ট্র একটি
নৈতিক সংস্থা। তাই একটি বিধান দ্বারা রাষ্ট্র চিরকাল তার অন্তর্গত জাতি বা জাতিসমষ্টিকে
শাসন করবে। এ কারণে মানুষও তার ব্যক্তি অধিকারের আইনে রাষ্ট্রের প্রতি কোনোরকম কর্তব্য
পালন না করেও রাষ্ট্রের দেওয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করে যেতে পারে। বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রকে
শ্রম দেবে। প্রকৃতি থেকে রাজনৈতিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে ওঠা মনুষ্যজাতির মধ্যে
তখন গড়ে ওঠে ন্যায় অন্যায়বোধ। কিন্তু তারও নির্দিষ্ট ধারণা কী? ন্যায় অন্যায়বোধ হচ্ছে তাই যা রাষ্ট্রের বিধানে রাষ্ট্রের সুবিধার জন্য
রচনা করা আছে। নাগরিকতার মাধ্যমে মানুষ যখন রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক সুবিধা লাভ করে,
তখন তাই-ই হচ্ছে মানুষের কাছে তার নৈতিক
স্বাধীনতা। অপরপক্ষে যদি মনুষ্যজাতির ইতিহাস দেখা যায় তাহলে বোঝা যাবে মানুষের জীবন
হল এক বিরাট বিশৃঙ্খলার সংগঠন। মানুষের মন যে ঘটনাকে স্বাভাবিক প্রকৃতিপ্রদত্ত মনে
করে, মানুষের বুদ্ধি সেটাকে যাচাই করে নেওয়ার কথা বলে। মানুষের
বুদ্ধি যে কাজের সমর্থন দেয়, হাত সেই কাজ করতে ভয় পায়। কিংবা
হাত যে কাজ করে, মুখ সেই কাজের কথা অস্বীকার করে। অথবা মুখ
যা বলতে চায়, চোখ তা মেনে নিতে রাজি নয়। মানুষের নিজের জীবনের
ভিতরেই কাজ করছে এক অসম্ভব অমোঘ বেদনা। সেই বেদনার প্রকৃত সত্তা কী তা আমরা কেউ কোনোদিন
জানতেও পারব না। বেদনা নিজের অবস্থান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মৌলিক সত্তাটিকে চিরকালের
জন্য আড়াল করে রাখে। এই অস্পষ্ট অন্ধকারকে সভ্যতার শুরু থেকেই মানবজাতি নিজের মধ্যে
সঞ্চয় করে আসছে। সেইসঙ্গে তার চেতনা এখনও পশুস্তরেই সীমাবদ্ধ আছে বলে তারা জগতের পবিত্র
সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না। শিশুই সবচেয়ে বেদনাময় জীবনের কাছাকাছি অবস্থান
করে। যা তাকে প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে, একটি শিশু প্রতিমুহূর্তে
লড়াই করে তার সেইসব পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠান চায়, কিংবা বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র চায় শিশুদের মতামতকে খর্ব করতে,
শুধুমাত্র তাদের যথেষ্ট বয়স
না হওয়ার কারণে। প্রতিষ্ঠান চায়, শিশুটি সবকিছু শিখুক প্রাতিষ্ঠানিক
দৃষ্টান্তের মধ্যে দিয়ে, যাতে তার জীবনের মধ্যে একটি পরম্পরা
রক্ষা পায়।
অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত হল, একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে গেলে সর্বদা
সরাসরি দাসপ্রথা চালু রাখলে হবে না। প্রভুকে শ্রমের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার শীর্ষে
রাখলে, শ্রমিক কিংবা নাগরিকদের একটা সময় পরে মনে হতে পারে
কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির অধীনে থেকে তারা শ্রম প্রদানে আর বাধ্য হবে না। শ্রমই
যদি রাষ্ট্রের মৌলিক উপার্জন হয়, তবে প্রভু বদলে গেলেও শ্রমিকের
অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ, সমাজব্যবস্থার দৈনন্দিন
পরিকাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এই রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় মাত্র দুটি শ্রেণি
বর্তমান থাকে। শাসক ও শোষিত সম্প্রদায়। শাসক, যে হবে রাষ্ট্রের
রক্ষাকর্তা ও প্রধান সম্পদভোগী, নীতিনির্ধারক। অপরপক্ষে শোষিত
সম্প্রদায়, অর্থাৎ নাগরিক কিংবা শ্রমিক, যাদের ওপর ভার থাকবে রাষ্ট্রের ঘাটতিগুলোকে পূরণ করা, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের কাছে তা মজুত করা। কিন্তু
এই শ্রেণির রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় শোষিত শ্রেণি যেহেতু রাষ্ট্রের সেবামূলক বা কল্যাণময়
কাজে নিযুক্ত, তাই তাদের মধ্যে একতা বিষয়টা থাকবেই। যে কোনও
গণ আন্দোলনে তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বিপাকে ফেলতে পারে। কাজেই, আর্থসামাজিক শাসনব্যবস্থায় শোষিত শ্রেণিকে ভেঙে ভিন্নতর ছোট ছোট শোষিত
শ্রেণিতে ভাগ করা হল। কৃষক, শ্রমিক, নাগরিক, শিক্ষিত ইত্যাদি। পেশা অনুযায়ী যারা ভিন্ন
কিন্তু শোষণব্যবস্থায় তারা একই। অর্থের মাধ্যমে এদের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে
দেওয়া হল। সমাজব্যবস্থায় একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করে বলা হল নাগরিকদেরও
নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, এবং অর্থ সংগ্রহের
মাধ্যমে তারা নিম্নতর শ্রেণি থেকে নিজেদের উচ্চতর শ্রেণিতে তুলে আনতে পারবে এবং অর্থের
বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রের ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার অংশীদার হতে পারবে। অর্থাৎ,
ভোগী সমাজব্যবস্থায় দখলের প্রশ্নে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করা হল। কেবলমাত্র
দক্ষতার ভিত্তিতেই হবে শ্রেণির উন্নয়ন। কেউ অন্যকে ঠকিয়ে অর্থ সঞ্চয় করে ভোগবাদী সমাজের
অংশ হতে চাইলে রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে সভ্যতায়
এসে দাঁড়াল আইন ব্যবস্থা। মনে করা হল, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও
সমাজব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত হবে। এতে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে
তৈরি হবে সামঞ্জস্য এবং সুসম্পর্ক যা একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অনন্তকাল টিকিয়ে
রাখবে। (ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment