চিরপাথরের দেশ ও কতিপয় কবিতা
ভূগোল খাতার ভাঁজে
আগুনের নিচে বরফ ছিল। আমি
তাকিয়ে দেখছিলাম কী হয়,
না হয়। বাবা বলেছিল লাল তারা এনে দেবে হাতে। মা বলেছিল পুঁইদানা ঘষে
রঙিন করে দেবে ভূগোল খাতার মলাট। ভূগোল খাতায় আঁকা ছিল গোল গোল পৃথিবী ও অপৃথিবীর
নাম। মাকে প্রণাম। বাবাকে প্রণাম।
ভগবানের হাতের কড়ে আঙুলে
একটা বিছা কামড়ে ধরে আছে। হাসছে ভগবান। আমাদের জলাশয়ে তার হাসির বন্যা। নর্দমায়
তার নাচন। আগুন পুড়ে যাচ্ছে বিছা ও বরফের দিকে। আমার চোখের পাপড়ি ধরে সারি বেঁধে
হেঁটে চলে যাচ্ছে কালো পিঁপড়ার দল, মা আর বাবা যেখানে গিয়েছে চলে আমাকে
ভূগোল খাতার ভাঁজে ফেলে।
টবের ফুল
আমার বারান্দার টবে
প্রতিদিনই ফুল ফোটে,
হরেক রকম ফুল। কিন্তু তাদের বেশিরভাগের দেখাই সহজে মেলে না। অনেক
ঝামেলা করে, উঁকিঝুকি মেরে, ডালপাতা
সরিয়ে দেখতে হয়। শয়তান গাছগুলি গ্রিল গলে বাহিরে গিয়ে ফুল ফোটায়। প্রতিটা ফুল যেন
সূর্যেরই ন্যাওটা। এই বদমাস ফুলেদের দেখলে কখনো আমার গায়ে আগুন ধরে যায় যেন। জল,
সার সব আমিই ঢালি, আদর-সোহাগ, যতœ সব আমিই করি। তবু তারা সূর্যগামী এই দেখে দুহাতে
টেনে গায়ে আগুন দিয়ে সূর্যকে ছাই করে দিতে মন করে প্রতিদিন। এক একদিন ভাবি শয়তান
গাছগুলি সব সমূলে বিনষ্ট করি, উপড়ে ফেলে দিই। তখন বদের বদ
ফুলগুলি বুঝবে মজা। কিন্তু পারি না।
মানুষকে মূলত এইভাবে বাঁচতে
হয়, এই জেনে বিবমিষা নিয়ে বেঁচে থাকি। সে আর তুমিও এমনভাবেই বাঁচো জানি।
চির পাথরের দেশ
প্রেমের দিকে উড়ে যায় দুপুর।
প্রেম আছে বাষ্প হয়ে,
চির পাথরের দেশে। দুপুর ভাবে প্রেমই নেবে তাকে।
দুপুর! তোকে তো নেবে পাথর।
তোর রৌদ্রকোমল শরীরে জড়িয়ে নে পাথরের চেয়ে পাষাণ কোনো কিছু।
দুপুরের শরীরে সূর্যের
ঘ্রাণ। মাথার ভিতর কুসুমিত হয় পৃথিবীর উষ্ণ সব পুষ্পদল। উড়ে যায় সে। কথা সব তার
পাশ ঘেঁষে উবে যায়। সে শুনতে পায় না।
দুপুর ওড়ে। তার শরীরে ক্রমে
লাগে বিকেলের রং। সে দেখতে পায় না রং, অন্ধ হয়ে যায়।
সূর্যের রং
একটা মানুষ মরে গেলে বাড়িতে
একটা ঘর খালি হয়। একটা চিরুনি, পানির গ্লাস, কোনো বাড়িতে
একটা খাট, একটা বালিশ। খালি হয় একপাটি চপ্পল, একজোড়া জুতা, কারো বা চশমা, সিকো
ফাইভ ঘড়ি, স্বর্ণের চেইন, গামছা,
চুরুট, রেজার, ওয়ারড্রোবে
ভাঁজ করা শাড়ি আর পেটিকোট, পাজামা, প্যান্ট,
কালো রং শার্ট, আরো কিছু জামাকাপড়, আন্ডার গার্মেন্টস, কারো বা গহনা, নীল রং টুথব্রাশ, লাল-নীল উলের মোজা, যা শীতে পরেছিল একপায়ে এক এক রঙের। আয়নায় লেগে থাকা টিপ আর পায় না কোনো
কপালের সন্ধান। ঘরের গন্ধ পালটে যায়। লুকোনো ডায়েরির কিছু পাতা খালি থেকে যায়,
কেবল রুলটানা থাকে। কেউ পড়তে গেলেই জানা যায় রুলটানা পাতাগুলির
রুলগুলির রং নীল।
একটা মানুষ মরে গেলে কখনো
আরেকটা মানুষ খালি হয়। কখনো কয়েকটা। রক্তের সম্পর্ক। বন্ধুবান্ধবেরও কয়েকদিন খালি
খালি লাগে। তারপর কয়েকদিন ক্রমে, তারপর দ্রুত সব পূর্ণ হতে থাকে। খালি মানুষটা
পূর্ণ হয়। টুথব্রাশ আর ছোটো কাপড় সব ফেলে দিয়ে বাকি জামা-কাপড় অন্যরা নিয়ে থুয়ে
বাকিসব কাজের লোকের কাছে দিয়ে জুতোজোড়া পায়ে হলে জুতোজোড়া পরে হেঁটে যায় কেউ,
যেইপথে প্রতিদিন সূর্য এসে মুছে দিয়ে যায় আগের দিন গায়ে লেগে থাকা
সূর্যের রং।
ভালো লাগলো
ReplyDelete