কবি মানস কুমার চিনি–র ‘ছিন্ন পদাবলি’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা
বেশ কয়েক বছর খড়গপুরে ছিলাম না।ফিরে আসি ২০১৮ তে।ফিরে স্টেশনের
বোগদার দিক দিয়ে সেদিন আসতে গিয়ে মানসদার কথা মনে পড়ে গেল। কবি মানস কুমার চিনি। এখানে একটি
রেল-কোয়ার্টার-এ থাকতেন
মানসদা।আর আমি মাঝে মাঝে মানসদার কাছে বাবুলাইনে সেই রেল-কোয়ার্টার-এ পৌঁছে
যেতাম মানসদার সাথে দেখা করতে ও তাঁর বই-এর সংগ্রহ দেখতে। সেটা
২০০২ সাল।ততদিনে মানসদার বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এরপর বেশ কয়েক বছর
বাংলার বাইরে ছিলাম। এই কয়েক বছরের মধ্যে মানসদার কিছু কবিতা বিভিন্ন
পত্রপত্রিকায়ও পড়েছি। তবে মানসদার পুরো একটি কবিতার বই পড়ার সুযোগ হয় নি । তবে
কিছুদিন আগে হাতে এল এই লকডাউনে শহর কলকাতায় বসে লেখা মানসদার নতুন কাব্যগ্রন্থ
‘ছিন্ন পদাবলি’। আজ এই কাব্যগ্রন্থ নিয়েই আলোচনা করব।
১
কবি মানসকুমার চিনির জন্ম ১৯৬৫ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের
ভগবানপুর থানার কলাবেড়িয়া গ্রামে। ১৯৮৮ সালে চাকরির জন্য এই রেলশহরে আসা।প্রথম
কবিতার বই প্রকাশিত হয় এই খড়গপুরেই।নাম ‘ নোনাবালি’। তারপর
বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এক –দু বছর পর পর। মানসদা আমাকে এক বছর আগে নিজে বলেছেন তাঁর এখনো অবধি
তেইশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এঁর আগে ২০২০ তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর
কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়া যুদ্ধ’। সেটিও আমার কাছে আছে। তাহলে ‘ছিন্ন পদাবলি’ই কি
মানসদার চব্বিশতম কাব্যগ্রন্থ !।
২
কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর সত্তর বছর পেরিয়ে গেছে।তাঁর
মৃত্যুর পরে জন্মান কোনো কবিই তাঁর প্রভাব এড়াতে পারেননি।এ ব্যাপার কবি শক্তি
চট্যোপাধ্যায় বলেন ‘আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন আমাদের বয়সী কবিরা
জীবনানন্দের দ্বারা।প্রভাবিত হয়েছেন, আবার প্রভাব কাটিয়েও উঠেছেন,তাঁর মত লেখা তো
সম্ভব না’।মানসদাও এক সময় অবধি তাঁর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি।তাই
জীবনানন্দের লাইন দিয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছেন –‘কি কথা তাহার সাথে’। প্রকাশিত
হয়েছিল ২০১৭তে। যত তিনি কবিতা লিখেছেন তত জীবনানন্দের প্রভাব ধীরে ধীরে কমেছে।এই
কাব্যগ্রন্থ মানসদা উৎসর্গ করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ সহ গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের
প্রধান কবিদের।প্রথম কবিতাটি কবি জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা ।‘বরিশালের স্বপ্ন
ওড়ে’কবিতায় মানসদা লেখেন
‘যে কবি
নরম ঘাসে শ্বাস নেয়
তার কবিতা
ধূসর বলে চলে যায়
আর এক তরুণ
কবি,
এই কবিতার শেষে কবি জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার
জন্য তিনি লেখেন
‘ আজ সব কবিসভা মাথা নিচু করে
বলে শতবর্ষে তুমি বড়ো কবি।
গাঙ- শালিকের দেশে
বিস্ময় ও বেদনা জেগে থাকে।
বা আর একটি কবিতায় তিনি লেখেন
‘
ধানসিড়ি নদীটির তীরে
বাংলাদেশ একা রাত জাগে
তোমার
দিকে ছুটে আসে
শীতের
কুয়াশা, রুপালি মাছের স্রোত
আর সেই কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে যখন তিনি লেখেন
ধানের
শীষে কৃষক সেজেছে
তোমার
প্রেমিকা কাছে, তাকে
রূপসী
বাংলা ডাকে।
তখন বোঝা যায় কবি মানস কুমার চিনি সারা জীবনই জীবনানন্দ
দাশ-কে ছুঁয়ে থাকতে চান।
৩
মানসদার জীবনের অনেকটা অংশই তাঁর গ্রাম ও এই রেলশহরে
কেটেছে। তাই মেদিনীপুরের গ্রাম,লালমাটি,পুকুর,ধানজমির গন্ধ তাঁর কবিতা জুড়ে। আশি ও
নব্বই দশকের প্রধান কবি শক্তি চট্যোপাধ্যায় বা শঙ্খ ঘোষ-এর মত শহরতলির রহস্যময়তা
তাঁর কবিতায় দেখা যায়। আর তাঁতে মিশে থাকে মেদিনীপুরের গ্রামের গন্ধ।
তিনি লেখেন ‘আজ খুলে দেয়
কবিতার
জানলা
মেঘের গায়ে
ছড়িয়ে আছে ডালপালা।
বা আর একটি কবিতায় লেখেন
বাঁশের বনে ছায়া পড়ে এলে
হৃদয়ের ছন্দে বয়ে চলে নদী,
এরপর আবার যখন লেখেন
মাটির
ওপর সূর্যের আলো পড়ে
কত ভোর
রাত্রি ক্ষয়ে ক্ষয়ে।
বোঝা যায় তাঁর কবিতায় মেদিনীপুরের মাটি, বাঁশবনের ছায়া,
গ্রামের রাত্রি ফিরে ফিরে আসে।
এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবিতার নামকরণের মধ্যেও লেগে থাকে
গ্রাম, নদী ,খোলা আকাশ ও তার রহস্যময়তা। যেমন জল ধ্বনি,রাত্রিবহন, মায়ালোক,জল ও
নারী, গানমেলার হাটে, কুলকাঁটা –ইত্যাদি।
৪
অন্ত্যমিল না রেখে কবিতায় শব্দ সাজাবার ধরণ বা বিন্যাস নিয়ে
‘সুনীল –শক্তি’-রা যে পরীক্ষা করেছেন তা মানসদার কবিতাতেও দেখা যায়। গদ্যের
আঙ্গিকে বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা স্বীকারোক্তিময় লাইন তাঁর কবিতার শেষে প্রায়ই দেখা
যায়।
একটি আশাময়তার কথা দেখা যায় কবিতার শেষে বা মানসদা যা
বুঝেছেন বা আশা করেন অবচেতনে তা দিয়ে কবিতা শেষ হয়।কিছু ভাললাগা
শব্দের বুনটে একটি রেশ তৈরি হয় ও থেকে যায় কবিতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। যেমন-
‘তোমার
কাব্য এই প্রকৃতির ভেতর
খুঁজে নেবে
ভাষা প্রাঙ্গণ’।
বা
শুধু এঁকে
চলো এক নির্মম সত্য
যা
স্মৃতির ভেতর জেগে থাকে’।
ও
তুমি জানো একটি সীমারেখা
অতিক্রম
করতে কতটা ঝুঁকি নিতে হয়।
৫
একটি নামকরা পত্রিকায় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
তাঁর সাক্ষাৎকারে জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামীর কবিতা সমন্ধে বলেছেন যে জয় যখন
রানাঘাটে থাকত তখন ভালো কবিতা লিখত। ও যখন সুররিয়ালিস্ট সব কবিতা লিখেছে, সে সব
একেবারে অনবদ্য। আমার কেন যেন মনে হয়েছে ও তার কবিতা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। তারপর
সাক্ষাৎকার যে নিচ্ছেন তাকে বলেছেন জানো,আমি ওকে বলেছিলাম জয়, তোমার সেই ফর্ম ধরে
রাখতে তুমি আবার রানাঘাট ফিরে যাও। তার মানে কবি জীবনানন্দ দাশ-এরও কি বরিশালে-এ
ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। কেন তিনি কলকাতার ইট, কাঠ,কংক্রিটের মধ্যে থেকে গেলেন। কেন
তিনি হাঁটতে লাগলেন ট্রামলাইন ধরে। কেন তিনি শুনতে পেলেন না ট্রামের শব্দ। সেই সময়
কি তিনি বরিশালের কথা ভাবছিলেন !। আর আমাদের মানসদা কি আর খড়গপুরের কথা ভাবেননা।
তাঁর কবিতায় খড়গপুরের কত কথা ছড়িয়ে আছে। মানসদার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রেলব্রীজে
সন্ধ্যা’। মনে হয় যেন পুরাতন বাজার হাতিগলা পোল –এর কথা ভেবে লিখেছেন।
মানসদা তাঁর রেল-কোয়ার্টারের সামনের বারান্দায় লিটল ম্যাগাজিন-এর একটি সংগ্রহ
বানিয়েছিলেন। রেল-কোয়ার্টারের সামনে নিজের হাতে বানিয়েছিলেন একটি বাগানও। সন্ধ্যাবেলা
বোগদায় মণিশঙ্করী বুকস্টলের পাশের চা-দোকানের সামনের আড্ডায় কি আর মানসদাকে দেখা
যাবে না। খড়গপুরের সাহিত্যসভাগুলিতে কি আর মানসদাকে কবিতা পড়তে শোনা যাবে না!।
৬
এই কাব্যগ্রন্থে আছে ৫৬ টি কবিতার।প্রথম দশটি কবিতার নামকরণ
নেই। শেষে আছে দুটি গদ্য কবিতা। বইতে একটি কবিতা কবি অরুণ মিত্র ও আর একটি কবিতা
কবি ও চত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী –কে নিয়ে লেখা।প্রচ্ছদ করেছেন এই রেলশহরেরই আর
এক চিত্রশিল্পী ও লেখক হিরণ মিত্র।
সমস্ত কাব্যগ্রন্থ জুড়ে আগের মতই কবি মানস কুমার চিনি- সুলভ
স্নিগ্ধ সহজ শব্দচয়ন ও উপমার সমাবেশ দেখা যায়। অবসরের আলস্য নিয়ে অভ্যাসগত ভাবে এই
কবিতাগুলি লেখা। বিষয়ে ও আঙ্গিকে নতুনত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এই কাব্যগ্রন্থ
পড়ার পর সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর কথার সুর ধরে বলতে ইচ্ছা করে – ‘মানসদা
যখন তুমি খড়গপুরে থাকতে তখন ভালো কবিতা লিখতে। তোমার
সেই ফর্ম ধরে রাখতে তুমি আবার খড়গপুরে ফিরে এস’।
No comments:
Post a Comment