আবিষ্ট হোন নির্দ্বিধায়; মেলাবেন, তিনি মেলাবেন
যে বইয়ের পৃষ্ঠপ্রচ্ছদের ভিতরে লেখকের পরিচয় প্রসঙ্গে লেখা থাকে, অনুরাগ স্বর্ণযুগের বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলী ও সনাতন টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ডুব দেওয়ায়... পছন্দ করেন শহর নৈহাটির পুরনো পথঘাটে ঘুরে বেড়াতে, এবং যে বই উৎসর্গ করা হয় শহর নৈহাটির খড়খড়ি-জানলার সেই পুরনো বাড়িদের, যারা লেখকের কিশোরমনে জাগিয়েছিল রহস্যময়তার প্রথম অনুভূতি; সেই বইয়ের কাছে গতানুগতিকতাবহির্ভূত কিছু চাহিদা থাকবে বই-কি। মুশকিল হল, চাহিদা একটা শূন্যাত্মক অবস্থা, এটা সৃষ্টি করতে হয়। মনে করা যাক ‘লুসিফারের লোকজন এবং অন্যান্য’-র সম্ভাব্য কোনো পাঠক ওই বাক্যগুলির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বইটি কিনলেন। তখন এটা কি বলা যাবে যে বাক্যগুলি পড়ে পুরাতন ও রহস্যরোমাঞ্চ বিষয়ে তাঁর মনে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল বলেই তিনি কিনলেন? এমন কি হতে পারে না যে এই বিষয় দুটোই পাঠক হিসেবে তিনি পছন্দ করেন, এবং সেই জন্যই খুঁজতে খুঁজতে আবেশ কুমার দাসকে তাঁর আবিষ্কার!
বই বিক্রি হওয়ার এ দুটো বোধ করি প্রাথমিক সম্ভাব্য কারণ। কিন্তু সেই পাঠকের কী হবে যিনি দুটোর কোনোটার দ্বারাই তাড়িত না-হয়ে বইটা হাতে পেয়ে গেছেন এবং অনুরুদ্ধ হয়েছেন: লিখতে হবে ক’টা কথা? রহস্যরসে অনাগ্রহী এবং রোমাঞ্চপ্রশ্নে পিষ্ঠকের-স্বাদ-না-জানা চাটুর দশাপ্রাপ্ত পাঠক-সমালোচক তখন খুঁজে ফেরে কথা ও দর্শন, যা উঠে আসে গভীর জীবনবোধ থেকে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে ঈর্ষা হয় সেইসব পাঠকের জন্য, যাঁরা পরিশীলিত-রহস্যময়তায়-আবিষ্ট আখ্যানের সন্ধানে থাকেন, এবং আবেশ কুমারকে স্বমিতিতে উপভোগ করতে পারেন। ‘...হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই/বিসমিল্লার পাগলা সানাই’— গায়ক সুমনের পক্ষেই বলা সম্ভব। আক্ষেপ করে লাভ নেই— কিশোর বয়সের পাঠকমনটা বেঁচে থাকলে, আবেশ কুমারের গল্পগুলো সম্পর্কে এমন কিছুই হয়তো লেখা যেত। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে না-পারার জন্য কষ্ট পেলে হবে না। সৌরেন্দু— মানে প্রথম গল্পটার সৌরেন্দু বলছিল, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা যে কী গাঢ় ছাপ ফেলে যায় মনের নরম পর্দায়। অবশ্য কড়া পাকের পাঠাভ্যাস আর জটিলকুটিল যাপনের মধ্যে থাকতে থাকতে পর্দাটাও পোড় খেতে থাকে। মনে হয়, বস্তুময় এই চেতন সংসারটাই শেষ বাস্তব; সরল বিশ্বাসের কোনো শৈশব আমাদের কোনোদিনই ছিল না বোধহয়। কিন্তু না, সৌরেন্দুই বন্ধু অমিতাভকে মনে করিয়ে দেয়, যে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়বে তোর চেতনা, তখনই ঘুম থেকে জেগে উঠবে তোর সেই অবচেতন...
মনের গহন অন্ধকারে, যেখানে ম্যানগ্রোভ জটিলতায় ওঁত পেতে থাকে আমাদের ইদস আর গূঢ়ৈষা, আবেশ কুমার সেখানে পৌঁছে যান স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ দক্ষতায়। ‘সরীসৃপ’ গল্পটা তার একটা আদর্শ নমুনা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমনামী আর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামক গল্প দুটোর কথা মনে এলেও, অতিশয়োক্তিতে দুষ্ট হওয়ার ভয়ে সংযত থাকাটাই শ্রেয়। সমকালীন সমাজ সর্পিল কুটিলতায় পেঁচিয়ে ধরে বিবেকের টুঁটি। ডুবন্ত আকাশকে রেখে পালিয়ে বাঁচে সহপাঠীরা; সহপাঠিনী সম্পর্কে বন্ধুদের বিকৃত কথাবার্তায় গা শিরশিরিয়ে ওঠে আকাশের, যার অধিশাস্তা অবচেতনে ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। পরিণতি ভয়ঙ্কর! চরিত্রের অনুষঙ্গে চলে এসেছে অতি সুপ্রাচীন বিবর্তনের রূপক। সরীসৃপ মানসিকতার প্রতি বিবমিষাবশত সলিল সমাধি না, নবজীবনের জন্য উদগ্রীব আকাশ। ‘...কয়েক কোটি শীতঋতুর অতীতে এই আধুনিক স্তন্যপায়ীটারই এক অতিকায় পূর্বপুরুষ তিমি সেকালের আর-এক রাক্ষুসে বুকে হাঁটার উপদ্রবে তিতিবিরক্ত হয়েই বেছে নিয়েছিল জলচর জীবন।’ পরিচিত চেনা বাস্তবকে দুমড়েমুচড়ে পরাবাস্তবের এমন একটা স্তর তৈরি হয় যে অনিবার্যভাবে স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পগ্রন্থ ‘এলভিস ও অমলাসুন্দরী’-র (২০১৭) কয়েকটি আখ্যানের কথা। উল্লেখ থাক, আবেশ কুমার দাসের এই গল্পটার প্রথম প্রকাশ ২০০৯-এ এবং এখানে যে রিট্রোগ্রেসিভ মেটামরফিজম-এর কথা এসেছে তা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে।
পরবর্তী গল্প ‘ছায়া’; পড়া যায় পনজি স্কিমের প্রেক্ষিতে। চটজলদি মুনাফা করার লুম্পেন ধনতন্ত্র যে সমাজ পোষণ করছে, তার এক এজেন্ট নিজস্বতাবর্জিত কায়াহীনতার দিকে এগোচ্ছে: ‘তার নিজের শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছায়াটাকেই অনেক খুঁজেও আর দেখতে পেল না কার্তিক।’ ছায়ারা ঘিরে ধরছে তাকে। আলোর বিচিত্র উৎসের বিচ্ছুরণপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে সে-ই সৃষ্টি করেছে এইসব ছায়া। কার্তিকের মতো দালালরা চুনোপুঁটি। এদের পেছনে থাকে রাঘববোয়াল, টাকার কুমির, জমিহাঙর অথবা কোনো রাজনৈতিক নীলতিমি। তাদের আশ্রয়ে সাফল্যের মধ্যগগনে থাকার সময় নিজেকেও চেনা যায় না: ‘ছায়াটা যে তারই, হাতের ওঠানামা দেখে নিঃসংশয় হয় কার্তিক। কিন্তু কেমন করে দুপুর বারোটায় মানুষের ছায়া এত দীর্ঘ হতে পারে বোধগম্য হয় না তার।’
অন্তিমে আকর্ষণীয় বাঁকবদলের রীতির প্রয়োগ ঘটানো ‘জাদুকর’-এর পরেই নামকরণে থাকা গল্পটার সামগ্রিক অবস্থান বইয়ের মাঝামাঝি। নারীত্বের অপব্যবহার, অ্যাবসার্ডিটি-জাদুবাস্তব নিয়ে নাচানাচি, সংস্কারমুক্ত খাদ্যাভ্যাস, রোম্যান্টিক সংগ্রামপ্রিয়তা, তর্কে জেতার মোহ, রবীন্দ্রনাথের ধর্মাচরণ, সাহিত্যিকের গুণ্ডামি, ইতিহাসের প্রায়শ্চিত্ত, শ্রেণিশত্রু ও প্রতিক্রিয়াশীলতা— সব মিলিয়ে এ-যেন একটা ভাবকীলক। এরপর আছে আরও তিনটে গল্প। রহস্যগল্প লেখার প্রাথমিক শর্ত— আগ্রহ ও ঔৎসুক্য জাগিয়ে রাখা— পূরণ করা ছাড়াও, ‘সৃষ্টির একুশ শতক’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত ‘অভিজিৎ’ গল্পটা দাগ কাটতে পারে দুটো প্রশ্নের জন্য: ‘নামাই হবে না যে প্ল্যাটফর্মে, চলেই যেতে হবে যেখান থেকে, দরকার কী মায়া বাড়িয়ে সেখানে অহেতুক?’ এবং ‘একই কাজে একই সময়ে একই পরিশ্রম করে কেন একই মূল্য পাবে না দুটো আলাদা আলাদা মানুষ?’ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন; শুধু এটুকুই বলার, বাস্তববোধ ও বস্তুবাদের এমন ইতিবাচক সংশ্লেষ অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে আবেশ কুমার দাসকে।
এই ভাবনাটাই আরও পোক্ত হয় ভয় নামক গল্পটায় এসে। হ্যারল্ড পিন্টারের ‘দ্য বার্থডে পার্টি’ বা নিদেনপক্ষে হালের অনির্বাণ বসুর ‘হাঁকামনা’ উপন্যাসের উচ্চকোটির স্বাদ হয়তো মিলবে না, কিন্তু ভয়ের মিথ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াটি সরেস: ‘একদিন সন্ধ্যাবেলা সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পেচ্ছাব করে এসেছিল গাছটার গুঁড়িতে।’ এই বোধ তৈরি হয় দর্শন থেকে। যার জন্য লেখক বুঝতে পারেন, তাড়াতাড়ি বেশি লাভের আশায় ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিস থেকে তুলে তুলে টাকাগুলোকে বেসরকারি জায়গায় বসানোর পরিবেশ কী করে রচিত হল এবং ছোট ব্যবসায়ীদের শিরদাঁড়া একেবারে ভেঙে দিয়েছে লকডাউন। সরকার না-চাইলে মানুষের কষ্ট গণহারে বাড়ার কথা নয়। এটাই ভয়ের মূল কারণ। কারণ জানা সত্ত্বেও রোগ যে কেন সারানো যাচ্ছে না তাও চিহ্নিত হয়েছে: ‘যার যে কথাটা, যে ব্যবহারটা মনে হত অনৈতিক, সোজাসুজি বলে দেওয়ার সাহস ছিল মুখের উপর। সেই সাহস ছিল বলেই হয়তো ছোটবেলার সব অমূলক ভয়গুলো পালিয়েছিল খিড়কির দোর দিয়ে।’ কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও আবেশ কুমারের প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্র ভয়কে জয় করতে পারে না; কারণ: নিঃসঙ্গতা। একক মানুষ ভয় পায়, সংঘবদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠে ত্রাসসৃষ্টিকারীর ভয়ের কারণ।
কেন আবেশ কুমার দাসের চরিত্ররা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না তার একটা কারণ বোধহয় ‘...নীল অহমিকার তলানিটুকু’ (বাড়িটা)। বনেদিয়ানা, সামন্ততন্ত্রের অবশেষ সত্ত্বেও তার ক্ষয়িষ্ণু গাম্ভীর্য, হয়তো আবেশ কুমারের গভীর টানের ক্ষেত্র। কিন্তু রুচিগত আভিজাত্য থাকলেও শব্দব্যবহারে কোনো শুচিবায়ুতা নেই। চরিত্র ও ঘটনার প্রয়োজনে অশ্লীল কথা এসেছে সহজস্বাভাবিকভাবে; আবার রয়েছে ডুম্পা, রহট, ফইজুতি, ডোকলা, আঁদের গাঁদের প্রভৃতি মান্যকথ্য শব্দও। শমীক ঘোষের মতো তাঁর গল্পেও ‘বিলীয়মান আলো আর আবছা অন্ধকার মিলেমিশে গলে গলে পড়ে কার্নিশ বেয়ে’ আর ‘বাদুড়ের ডানার মতো ছেয়ে আসা অন্ধকারে গলে গলে মেশে তামাটে জ্যোৎস্নার পাণ্ডুরতা।’ ভূত-প্রেত-দত্তিদানো-রহস্য-রোমাঞ্চর তরল বাজারে যাঁরা আর আনন্দ পাচ্ছেন না, তাঁরা উন্নত রসাস্বাদনের জন্য আসতে পারেন; আর যাঁরা সিরিয়াস সাহিত্যচর্চার মধ্যেই একটু বিরতি খুঁজছেন, তাঁরাও স্বাগত: রুচিবোধের সঙ্গে আপোষ করতে শেখেনি আবেশ কুমার দাসের ঝরনাকলম।
লুসিফারের লোকজন এবং অন্যান্য/ আবেশ কুমার দাস/ বেঙ্গল ট্রয়কা পাবলিকেশন/ ১৯৯ টাকা
No comments:
Post a Comment