পুরাভাষার প্রহরী
কয়েকদিন ধরেই ফেসবুকে তার এক কবিতার পোস্টে করা লোকটির মন্তব্য
তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমনিতেই সে খুব অহংকারী লেখক। নিজের লেখার সামান্য সমালোচনাও
সে সহ্য করতে পারে না। তার অন্তত এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সে-ই এই মুহূর্তে
বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখক। হয়তো ফেসবুকে তার পোস্ট দু’শোটির বেশি লাইক
পায় না। হয়তো তার বই বইমেলায় খুব বেশি হলে দেড়শো কপি বিক্রি হয়। কিন্তু ধ্রুপদী
সাহিত্যের এটাই দস্তুর। এটা সে বিশ্বাস করে। যুবক হলেও সে অনেক গুণী, পণ্ডিতমানুষের
প্রশংসা পায়। সকলে অন্তত এটা বোঝে যে বেশিদিন তাকে অবজ্ঞা করা বা দূরে সরিয়ে রাখা
খুব সোজা কাজ নয়। রসিক সমাজের এই ইঙ্গিত সে নিজেও বোঝে, তাই তার লেখা বা বই নিয়ে উলটোপালটা
মন্তব্য করলে কাউকে সে ছেড়ে কথা বলে না।
লোকটি তাকে আক্রমণ করেননি। কিন্তু এমন এক মন্তব্য
করেছে যে সেটা তাকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। তার মন্তব্যে এমন এক
জোর আছে যে তাকে হেসে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। হয়তো লোকটি উন্মাদ, নয়তো রহস্যময়। এই
রহস্যময়তা তাকে অস্থির করে তুলছে।
ছড়ানো-ছেটানো লেখার টেবিল। জানলার ধারে রাখা
একটা মানিপ্ল্যান্ট গাছ জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। বৈশাখের রোদ চড়ছে ক্রমশ। গাছটাকে এনে কিছুদিন
ছায়ায় রাখা দরকার। বারবার ভুলে যাচ্ছে। স্কুলের জন্য বেরোবে। সকালে স্নান করে
লেখার টেবিলে বসেছে, যাতে বিভাষিত পত্রিকার জন্য লেখাটা অন্তত আজকের মধ্যে শেষ করা
যায়। ওরা এবার দস্তয়েফস্কিকে নিয়ে একটা সংখ্যা বের করবে। তাই একটা লেখা চেয়ে
পাঠিয়েছে। দস্তয়েফস্কির লেখায় ডিকেন্সের প্রভাব নিয়ে সে লিখবে তেমনই ভেবে রেখেছে। অনেক বইপত্র,
ইন্টারনেট ঘেঁটেছে। কিন্তু কি-বোর্ডের কাছে বসে তার মন কেবলই ওই মন্তব্যের দিকে ফিরে
যাচ্ছে। অথচ লেখাটা আজকের মধ্যে মেল না করলেই নয়।
স্কুলের টিচার্স রুমের পাশে বাইকটা দাঁড়
করিয়েই তার মনে হল আসার পথে সে বাইকে তেল ভরতে ভুলে গেছে। যা অবস্থা রিজার্ভ দিয়েও
পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ। ছুটে এসে এগারোটা পাঁচে সই করে
পকেটে হাত দিয়ে দেখল চাবি নেই। তার মানে তাড়াহুড়োতে দরজায় তালা না দিয়েই চলে এসেছে। আজ কাল আবার বিজেপি
বন্ধ ডেকেছে। স্কুলে চারটে অব্দি থাকতেই হবে। বাড়িতে যদিও নেবার কিছুই নেই। খালি
তার নতুন কেনা পিসিটা টেবিলের ওপরে রাখা। ওটা গেলে তার সর্বনাশ অনিবার্য। ওর
মধ্যেই তার যত সাহিত্যিক সম্পত্তি। রোলকলের খাতাটা বগলদাবা করে হাসিহীন গম্ভীর
মুখটাকে আরও কঠিন করে সে ক্লাসের দিকে রওনা দিল।
আপনার লেখায় অ্যারামাইক সাহিত্যের প্রভাব খুব
স্পষ্ট। আপনি নিশ্চয়ই সেই সাহিত্য খুব মনোযোগের সাথে পড়েছেন। (বিস্ময় ইমোজি ১০, হাহা
৩০)
অ্যারামাইক???? বাংলা আর ইংরিজি ছাড়া আর অন্য
কোনো ভাষায় আমার দক্ষতা দূরে থাক, তা পড়ার ক্ষমতাও নেই। (লাইক ৪০)
এটা আপনার বিনয়। আপনি হয়তো গোপন করছেন। কিছু
কিছু জায়গায় প্রভাব ছেড়ে দিন প্রায় কপি-পেস্ট হয়ে গেছে। (রাগি ৩০, লাইক ৫)
দেখুন আপনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। কোথা থেকে
উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। বেমক্কা কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন। আর আপনি কার লেখার
বিরুদ্ধে কথা বলছেন সেটা ভেবে দেখুন। (লাইক ৩০, কেয়ার ৩০, হাহা ২)
আপনি অহেতুক রাগ করছেন। আমার কথাটা ধরতে
পারেননি। (বিস্ময় ২০, রাগি ২০, লাইক ৩)
(আপনি কার সম্পর্কে বলছেন কাকাবাবু? আপনারই বা
অ্যারামাইক সাহিত্যে দক্ষতা কতটা? আমরা জানতে চাই।) (হাহা ৪০)
(আপনি সুস্থ তো? নাকি সকাল সকালই জলপান বেশি
হয়ে গেছে?) (হাহা ৩০)
(বাংলা সাহিত্যের নতুন অ্যারামাইক জ্যাঠামশাই!
স্বাগত!) (হাহা ৫০)
‘কপি-পেস্ট’ কথাটা যে কোনো লেখকের পক্ষেই
অত্যন্ত অসম্মানজনক। আপনি ওই অংশটা বাতিল করুন। (লাইক ৬০)
বাতিল কী করব ভাই? আমার নিজেরই তো চোখ কপালে
উঠে যাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব? ( বিস্ময় ৩০, হাহা ২০, রাগি ১০)
দেখুন আপনি আমার দাদা নন। আমিও অচেনা অজানা
লোককে দাদা বানাতেও পারব না। আপনি এবার আসুন। অনেক হয়েছে। আপনি আমাকে বিরক্ত নয়
রাগিয়ে দিচ্ছেন। (লাইক ৫০)
অ্যারামাইক? লোকটার কি সত্যিই মাথাখারাপ নাকি
ইচ্ছে করে তার পেছনে লেগেছে? ছেলেদের কিছু গ্রামারের কাজ দিয়ে বাইরের জানলার দিকে
তাকিয়ে সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। অ্যারামাইক নিয়ে সত্যিই তার কোনো পড়াশুনো
ছিল না। কয়েকদিন ধরে সময় পেলেই অ্যারামাইক নিয়ে গুগল খুঁজে চলেছে। অ্যারামাইক নিয়ে
যেসব বইপত্র বেশিরভাগই পণ্ডিতদের লেখা। তার ঐতিহাসিক ও কিছুটা ভাষাতাত্ত্বিক
গুরুত্ব নিশ্চয়ই এখনও আছে। কিন্তু অ্যারামাইক সাহিত্য? সে এখনও তেমন কিছু আছে বলে
খুঁজে পায়নি।
তবে লোকটির বিনীত অথচ জেদি মন্তব্যটা তার মাথা
থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। তার বন্ধুদের ও ভক্তদের মধ্যে বেইজ্জতি নয়,
কারণ সে নিজে জানে যা মিথ্যে তা নিয়ে ভাববার কিছু নেই। তবে ঘটনাটা যদি সত্যি হয়!
সত্যিই যদি তার লেখায় অ্যারামাইক প্রভাব থাকে! এর রহস্য কী হতে পারে?
লোকটিকে একদিকে সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। আবার অন্যদিকে তার
মন্তব্যের রহস্যময়তা তাকে সমানে টেনে ধরছে। বিরক্ত করছে। এমন সময় হোয়ার নোটিফিকেশন
পিং করে বেজে উঠল।
আমি আপনার ‘অ্যারামাইক জ্যাঠামশাই’ বলছি। যদি
কিছু মনে না করেন একদিন আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আমি টালিগঞ্জে থাকি। আমি জানি
আপনি ব্যান্ডেলে থাকেন। এই রবিবার যদি একটু সময় দেন। মিনিট পনেরোর বেশি নেব না।
ঠিক আছে সকাল দশটায় আসুন। বেশি সময় দিতে পারব
না। আর আমি অভদ্র লোক। আমার কাছে খুব ভদ্রতা আশা করবেন না।
ওকে। ধন্যবাদ। আমি খুব ভদ্রলোক। আমার কাছ থেকে
কোনো আক্রমণ আশা করবেন না।
সকাল ঠিক দশটায় বেল বাজল। লোকটির সময়জ্ঞান
সত্যিই প্রশংশনীয়। রান্নার দিদি রান্নাঘরে। রোববার দিদি একটু দেরি করেই আসে। দরজা
খুলে ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসতে বলে ও দু-কাপ চা করতে বলল।
চারিদিকে অপরিচ্ছন্ন টেবিল। এলোমেলো বিছানা।
সারা বিছানায় বইখাতা ছড়ানো। তার বসার আর শোবার ঘরের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। বইগুলো
পাশে সরিয়ে দিয়ে সে লোকটির উলটোদিকের চেয়ারে মুখোমুখি বসল।
সকাল সকাল ছুটির দিনে আপনাকে এভাবে বিব্রত
করার জন্য আমি দুঃখিত। কথা দিচ্ছি বেশি সময় নেব না।
পাকা গমের মতো গায়ের রং। বাঙালিদের তুলনায়
যথেষ্ট লম্বা। চেহারার গড়ন দেখে বাঙালি বলে মনেও হয় না। মাথার সামনের দিকের চুল
কমে এসেছে। খুব বেশি হলে ষাট। মাথার চুলগুলো লালচে। হয়তো
মেহেন্দি করেন। নিপাট পরিচ্ছন্ন মানুষ। এই রোববারের সকালেও ক্লিন শেভ করে এসেছেন। গা
থেকে হালকা একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। চেনা ডিও কিছু নয়। ইস্তিরি করা ব্র্যান্ডেড শার্ট
আর প্যান্ট। গুঁজে পরা। গুছিয়ে বসেছেন। তার এই অসম্ভব অগোছালো ঘরটিতে লোকটি যেন প্রচণ্ড
বেমানান। মুখে বিনয়ী কথা বলছেন বটে কিন্তু তার চেহারায় বিনয়ের কোনো অপ্রস্তুতভাব
নেই। উলটে যেন এক প্রচ্ছন্ন রসিকতা ও সাবলীলতা। আর সেটাই
তাকে খুব নার্ভাস করে দিল।
চা খাবেন তো? সে সহজ হবার চেষ্টা করল। কথার
সরাসরি উত্তর না দিয়ে।
চিনি ছাড়া। বিস্কুট না।
এবার বলুন আপনি আমার কাছে কী জানতে চাইছেন?
আমি একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি। আপনাকে খুব বেশি সময় দিতে পারব না।
আমি আগের প্রশ্নই আপনাকে করতে চাইছি, আপনার
লেখায় অ্যারামাইক সাহিত্যের এত প্রভাব কোথা থেকে এল?
দেখুন এর উত্তর আমি আগেই দিয়েছি। আমার বক্তব্য
পালটানোর কিছু নেই। আপনি আমাকে বলুন তো অ্যারামাইক ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আপনারই বা
এত দখল কীভাবে এল? আমি তো বাঙালিদের এমন কাউকে চিনি না বা জানি না যিনি অ্যারামাইক
নিয়ে গবেষণা করেছেন।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিও কাউকে চিনি না।
চিরকালই আমার প্রাচীন ভাষার প্রতি আগ্রহ। সুমেরীয় কিউনিফর্ম থেকে মিশরীয়
হায়ারোগ্লিফিক্স আমি নিজের চেষ্টা ও আগ্রহে শিখেছি। এখনও শিখছি। আমি এখনও স্বপ্ন
দেখি কোনো একদিন ঘুম থেকে উঠে আমি দেখব সিন্ধু সভ্যতার রহস্যময় লিপির পাঠোদ্ধার
আমি করে ফেলেছি।
কিন্তু অ্যারামাইক তো আর এদের মতো পুরনো নয়।
সে তো অপেক্ষাকৃত নতুন।
সে আপনি খানিকটা ঠিক বলেছেন। প্রাচীন অ্যারামাইক
অনেককাল আগে থেকে চলে আসলেও আসিরীয় সম্রাটেরা ব্যাবিলন দখল করে আধুনিক
অ্যারামাইককেই তাদের রাজভাষা করে নেন। তারপর থেকে ওই অঞ্চলের এলিট ভাষা হয়ে ওঠে
অ্যারামাইক।
হ্যাঁ, সেসব আমি জানি। যিশুর মুখের ভাষা ছিল
অ্যারামাইক। তা হিব্রুর থেকেও অনেক প্রাচীন।
একদম। যেহেতু তা যিশুর মুখের ভাষা। ডেভিডের
ভাষা। মোজেসের ভাষা। তাই সেই ভাষার প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। আপনি কি মেলুয়ার নাম
শুনেছেন?
না।
মেলুয়া সিরিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার এক গ্রাম।
ওখানকার লোকেরা এখনও অ্যারামাইক ভাষায় কথা বলেন। আমি কয়েক বছর মেলুয়ায় কাটিয়েছি।
ওখানে অ্যারামাইক শেখার একটা ছোটখাটো ইস্কুল মতো হয়েছে। মেলুয়াও জেরুজালেমের মতোই
এক এলাকা যেখানে কিনা ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টানরা পাশাপাশি বাস করে।
হুম্। তবে অ্যারামাইক সাহিত্য কিছু আছে বলে
আমি কখনও শুনিনি। মানে গুগলও শোনেনি। আপনি বারবার সাহিত্য সাহিত্য করছেন কেন?
করছি তার কারণ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে
অ্যারামাইক ভাষায় এক অত্যন্ত আধুনিক ও ইঙ্গিতময় সাহিত্য রচিত হয়েছিল।
সেটা কি ওল্ড টেস্টামেন্ট ও ডেড সি স্ক্রোলস-এর
বাইরে বলছেন?
অবশ্যই। আমি যখন সাহিত্য বলছি তা সাহিত্যই।
আমি খুব সংগত কারণেই ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ডেড সি স্ক্রোলসকে ঐতিহাসিক বিবরণী বলব।
সাহিত্য বলতে পারব না।
তাহলে আপনি কি এমন কিছুর কথা বলছেন যা বাইরের
পৃথিবী এখনও জানে না?
(কিছুক্ষণ নীরব থেকে) একদম তাই। আর আমি অবাক
হয়ে দেখছি সেই আড়াই হাজার বছর আগেকার এক কাব্য থেকে আপনি আপনার নতুন সিরিজের একটার
পর একটা কবিতা লিখে চলেছেন। আমিও তাই আপনার কাছে অবাক হয়ে জানতে চাইছি এটা কী করে
সম্ভব?
আপনি যা বলছেন তার স্বপক্ষে আপনার কাছে কিছু
প্রমাণ আছে?
গুরুতর প্রমাণ আছে। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে
হচ্ছে আপনি সত্যিই অ্যারামাইক জানেন না। তাহলে সেই পুঁথি পড়বেনই বা কীভাবে?
এই কথা বলতে বলতে লোকটি মোবাইলে তোলা কিছু ছবি
তাকে দেখাবার জন্য সামনে ঝুঁকে বসলেন। সে দেখল ছেঁড়া কিছু পুঁথির পাতা। অনেকটা
ইন্টারনেটে দেখা ডেড সি স্ক্রোলস-এর পাতাগুলোর মতো।
এগুলো কী?
এটাই সেই অ্যারামাইক সাহিত্যের একটা পাতা যাকে
আমি মেলুয়ার অদূরে এক পাহাড়ের গুহা থেকে আবিষ্কার করেছিলাম। এখনও বাইরের পৃথিবী এর
খবর রাখে না। এগুলো প্রাচীন অ্যারামাইক ভাষায় লেখা। আমি তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে গত
দু’বছর ধরে এর পাঠোদ্ধার করে চলেছি। এটিকে আপনি একটি প্রাচীন রোমান্স বলতে পারেন।
এর সঙ্গেই কি আপনি আমার কবিতার মিল পেয়েছেন?
মিল নয় শুধু অবিকল এক। এমনকি আপনার কবিতায়
প্রেমিকার নাম রেখেছেন মারগোনি। আড়াই হাজার বছর আগে লেখা এই রোমান্সেও নায়ক যুবরাজ
এস্মায়েল তার প্রেয়সীকে ওই নামেই ডাকে।
এটা তো কাকতালীয় হতে পারে।
পারে কিন্তু বাকি কাব্যের বিষয়, যুবরাজ ও
মেষপালকের মেয়ের রোমান্সের প্রেক্ষাপট ও পরিণতি যা ঘটেছে এই পুঁথিতে সেটাই লেখা
আছে।
শুধু একটি কবিতা?
না শুধু একটি নয়। গত দু’বছর ধরে আপনার লেখায়
আলো ও কালোর যে তুলনা, বারবার যে ধ্বংস বা অ্যাপোক্যালিপ্স-এর কথা উঠে এসেছে,
বারবার উঠে এসেছে মেসিহার কথা, তা এই অ্যারামাইক সাহিত্যে বা কাব্যোপন্যাসে হুবহু
উল্লেখ করা আছে।
তার উল্লেখ থাকতেই পারে। ইহুদিদের মধ্যে এই
ধারণা বহু প্রাচীনকাল থেকেই আছে। যিশু নিজে সেই রাব্বানিক ইহুদিদের ধর্মের নামে
ব্যবসা ও দুর্নীতি নিয়ে সরব হলেও তাঁর নিজের ইহুদি ধর্মের ভিতর থেকেই সেই মেসিয়ার
ধারণাকে নিজের মধ্যে লালিত করে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে
চেয়েছিলেন। নিজেই হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন মেসিয়া।
আমি যে সাহিত্যের কথা আপনাকে বলছি তা যখন লেখা
হয় যিশুর পৃথিবীতে আসতে তখনও পাঁচশ থেকে হাজার বছর দেরি আছে। আপনি এসিন সম্প্রদায়ের
নাম শুনেছেন? জানেন তারা কারা?
তেমন কিছু জানি না। তবে শুনেছি অনেকে বিশ্বাস
করেন ডেড সি স্ক্রোলস যাদের লেখা তারা নাকি ওই সম্প্রদায়ের মানুষ।
সেটা খুব সাধারণ একটা অনুমান। এসিন একটা বহু প্রাচীন
ধর্মবিশ্বাস। আমার তো মনে হয় যিশু নিজেও সেই ধর্মবিশ্বাসে দীক্ষিত ছিলেন। এসিনদের
থেকে দীক্ষিত হলেও যিশু কিছুটা নিজের মতো করে তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন।
আপনি কি তাহলে বিশ্বাস করেন যিশু নামে আদৌ কেউ
ছিলেন?
অর্ধেক মানব অর্ধেক কল্পনা। যিশু এমন এক মানুষ
যাঁকে দু’হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকটা আপনাদের কৃষ্ণের মতো। এক পল্লবিত নায়ক।
দেখুন আপনি সত্যি বলছেন না মিথ্যে বলছেন তা
বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই কারণ আমি আগেই বলেছি আমি ভাষাটা জানি না। তর্কের
খাতিরে যদি ধরে নিই যে আপনি ঠিক কথা বলছেন তাহলে এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
আমি কিছু বলার আগে আপনার সিদ্ধান্তটা জানতে
চাইছি।
আমি সব সময় একটা জেনারেল কনসাসনেস-এ বিশ্বাস
করি। আমার মনে হয় এই মহাবিশ্বের একটাই জ্ঞানের আধার আছে। বা রসের আধারও বলতে
পারেন। আমরা সবাই সেখান থেকেই রস বা জ্ঞান আহরণ করছি। উৎস যেহেতু এক তাই কখনও কখনও
চিন্তা এবং চেতনা এক হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমন কোনো লেখকই নেই যিনি দাবি করতে
পারেন তাঁর লেখা অন্য কারোর দ্বারা প্রভাবিত নয়।
তা বলে অ্যারামাইক আর বাংলা?
হ্যাঁ, হতেই পারে। পরিসংখ্যানবিদ্যার নিয়ম ঠিক
হলে তিন হাজার বছর আগেকার কোনো লেখা যা কিনা সেই একই উৎস থেকে এসেছিল, সম্পূর্ণ
কোনো অপরিচিত চেতনায় তার সহোদরকে খুঁজে পেয়েছে। আপনি কি বলেন?
আমি এতটা দার্শনিক কল্পনায় যেতে পারছি না। আমি
খুব সোজাসুজি ভাবছি।
তাহলে আপনার মতামতটা শুনি।
আমার মনে হচ্ছে আপনি একজন টাইম ট্রাভেলার।
আপনি এসিন সম্প্রদায়ের লোক। এই পৃথিবীতে এসে আংশিকভাবে স্মৃতিভ্রম হয়েছে আপনার। আপনার
হয়তো প্রথম দিন থেকেই আমাকে উন্মাদ বলে মনে হচ্ছে। এ কথা শোনার পর আজ হয়তো
আপনার মনে কোনো সন্দেহই থাকবে না। কিন্তু আমি নিশ্চিত। আমি যা বলছি তা আমি
বিশ্বাস করি।
দেখুন আমি সাহিত্যের লোক। বিজ্ঞান জানি না।
তবে আমার মোটা মাথায় যতটুকু জানি এখনও পর্যন্ত মানুষ টাইম ট্রাভেল করার মতো
প্রযুক্তি অর্জন করতে পারেনি।
এখনকার মানুষ পারেনি। কিন্তু তিন হাজার
বছর আগের মানুষ পারত না আপনি এটা কীভাবে জানলেন?
যে যুগে মানুষ লোহালক্কড় নিয়ে যুদ্ধ করত সেই
যুগের প্রযুক্তি নিয়ে আমি খুব আশাবাদী হতে পারছি না।
আপনি কি যোগসাধনায় বিশ্বাস করেন? বিশ্বাস করেন
যে আমাদের মন বা চেতনা যাই হোক না কেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচণ্ড এক ক্ষমতা কেউ
কেউ অর্জন করতে পারেন?
আপনি কি বলতে চান এসিন সম্প্রদায়ের মানুষেরা
সেই যোগাভ্যাস জানত এবং তারাই আমাকে এই ভবিষ্যদকালে পাঠিয়েছেন তাদের ভাষার কথা
তুলে ধরতে?
হতেও পারে। কে বলতে পারে? জীবন অপার রহস্যময়।
সবকিছুকেই রহস্য বা ম্যাজিক বলে বিচার করা এক
ধরনের স্নায়বিক দুর্বলতা। আমি মানুষ হিসেবে এতটা দুর্বল নই। আর একটা কথা বলুন, আজ
নয় আমার বাবা-মা মারা গেছেন, তাঁরা একদিন জীবিত ছিলেন। তাঁরা আমাকে ছোট থেকে বড়
করেছেন। শৈশবের স্মৃতিও আমার মনে টাটকা। আমার জন্ম যে এই ব্যান্ডেলেই তাই নিয়ে
আমার কোনো সন্দেহই নেই।
জন্মের স্মৃতি আর কার থাকে বলুন? জন্ম-মৃত্যু
তো একটা গোলোকধাঁধা। আমরা ক্রমাগত সেই চক্রে আবর্তিত হতে থাকি।
আপনি জানেন কি এসিন
সম্প্রদায়ের কী পরিণতি হয়েছিল?
না।
অনেকে বলেন রোমানদের বিরুদ্ধে প্রথম ইহুদিদের
বিদ্রোহকে নেতৃত্ব দিয়েছিল এসিনরা। রোমান সৈন্যরা জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়ে তাকে
বাইরে থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তার পরে জেরুজালেমে ঢুকে গণহত্যা চালায়। এসিনরা
থাকত মরুপাহাড়ের গুহায়। তাদের খুঁজে বের করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবাইকে হত্যা করেছিল।
রোমানরা প্রতিহিংসার ব্যাপারে ইতিহাসে তুলনাহীন। একজনও এসিন সম্প্রদায়ের কেউ জীবিত
ছিল না। সম্পূর্ণ সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধু ডেড সি স্ক্রোলস থেকে আপনারা
তাদের কথা জানেন। আরও তাদের কত স্ক্রোলস চাপা পড়ে আছে এখনও তার সন্ধান মেলেনি।
আমার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে বলে কি আপনার মনে
হয়?
হতে পারে। তাদের কেউ হয়তো আপনার সাথে যোগাযোগ
রেখেই চলেছে। আপনি নিজে তা জানেন না। কিংবা জানলেও ভুলে যাচ্ছেন। তিনি হয়তো চান না
আপনি আসল সত্যিটা জানুন।
তিনি চাইবেন না কেন?
তাঁর সাথে হয়তো আপনার নিবিড় কোনো সম্পর্ক আছে।
যে সম্পর্ক পৃথিবীতে সবচেয়ে শুদ্ধ। তিনি হয়তো চান না আপনি বিভ্রান্ত হন।
তাহলে তাঁর উদ্দেশ্যই বা কী? তিনি আমার মধ্যে
দিয়ে কী দেখতে চান?
তাঁর হয়তো কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিংবা তাঁর
উদ্দেশ্য হয়তো সফল হয়েছে। তবু তিনি মানসিক দুর্বলতায় বারবার আপনার কাছে ফিরে আসেন।
তাহলে তিনিই হয়তো টাইম ট্রাভেলার। আমি নই।
কিংবা হয়তো আপনারা দু’জনেই। একজন জানেন, একজন
জানেন না।
তাঁর নিশ্চয় অনেক দায়িত্ব? তাঁকে কি ফিরে যেতে
হবে?
হ্যাঁ, ফিরে গিয়ে তাঁকে চিরদিনের মতো হারিয়ে
যেতে হবে। তাই তিনি তাঁর সম্পর্কের কাছে শেষবার ফিরে এসেছেন।
তিনি কি সুখী?
অবশ্যই। তিনি তাঁর চেতনার দায়, ভাষার দায় থেকে
নিজেকে অন্যের মধ্যে মিলিয়ে দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন।
সে লোকটির দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। সে এতক্ষণ
কী বলল কেন বলল কোনোটাই যেন সে বুঝতে পারছে না। তার অহম, ইগো সব কোথায় গেল কে জানে?
সে যেন নিজের সামনে রাখা এক বিরাট আয়না দেখতে পেল।
বেশ তাহলে চলি। আপনার থেকে পনেরো মিনিট সময়
চেয়েছিলাম। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ক্ষমা করবেন।
এ কি, আপনার চা তো দিদি দিলই না।
আরে থাক থাক। ভুলে গেছেন। ওনার
বাড়ি বাড়ি রান্নার তাড়া আছে। আজ আসি।
বলে তিনি তাঁর হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
এত জোরে করমর্দন করলেন যে তার হাতে যেন কী বিদ্যুৎ খেলে গেল।
ভদ্রলোক চলে গেলে সে দেখতে পেল তার মাথা কেমন
হালকা হয়ে আসছে। কোনোভাবে ছুটতে ছুটতে সে তার বাবার ঘরে গিয়ে তাঁর ছোট কাঠের
বাক্সটা খুলল। দেখল তার মধ্যে একটা পেন্ডেন্ট। সোনার চেনের সঙ্গে ঝুলছে একটা গোল
কয়েন। খুব কাছ থেকে দেখল তাতে অ্যারামাইক ভাষায় লেখা ‘অন্ধকার থেকে আলোয়’। সে অবাক
হল। ভাষাটা এই প্রথম ও পড়তে পারল।
মাথাটা কেমন হালকা হয়ে আসছে। সে বসার ঘরে এল।
তার উলটোদিকের চেয়ার দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কেউ কিছুক্ষণ আগে বসেছিল। কেউ কি
এসেছিল সকালে তার সঙ্গে দেখা করতে? না না, তা কী করে হবে, সে তো এই সবে ঘুম থেকে
উঠল।
রান্নার দিদি দু’কাপ চা নিয়ে এল।
দাদা চা। দেরি হয়ে গেল। ভুলে গেসলাম।
দু’কাপ কেন?
আপনিই তো বললেন!
আমি বললাম? সত্যিই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে
গেছে। কাল দরজায় তালা না দিয়ে চলে গেছি। ভাগ্যিস...
যা হোক, এনেছি যখন খেয়ে নিন। আর আমি আজ চললাম।
কাল আসব না। বেশি করে রেঁধে গেছি। ফ্রিজে তুলে রেখে দেবেন।
আচ্ছা, তুমি এসো।
তার হাতে পেডেন্টটা ধরা। নীচে কয়েনটায় কী যেন
লেখা। কী একটা ভাষা কে জানে?
বাবাকে মাঝেমাঝেই সে এই পেন্ডেন্টটা নিয়ে বসে
থাকতে দেখত। সে কাছে এলেই লুকিয়ে নিতেন। হঠাৎ করে
পেন্ডেন্টটা তার হাতে কিভাবে এল এখন সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
অসাধারণ, লেখক কে সেটা না জেনেই বলি এই গল্প পড়ে আমি তার চেতনার দূরত্ব মাপার দুঃসাহস করবো না।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।
Deleteহৃষীকেশ বাগচীর লেখা আগেও পড়েছি। অসাধারণ লেখনি। খুব ভালো লাগল এই গল্পটি। দুর্দান্ত।
ReplyDeleteপৃথা চট্টোপাধ্যায়।
ভালো লাগলো দিদি।
ReplyDelete